Purchase!

প্রেমের কবিতা

পা চেটে দেয়া, পেরে ওঠা, অন্ধকারে শ্রদ্ধা করা, লজ্জায় বৃষ্টিতে ভিজতে না-পারা, টায়ার হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা এ সবই অন্য কোনো ঘোরের জগত। আমাদের ক্লিশে ‘ওগো, হ্যাঁগো, আমি, তুমি’র কবিতার জগতে একগুচ্ছ জুঁই একটা বড় ব্ল্যাকহোল অনাবিষ্কৃত, অচেনা কিন্তু প্রবল তার টান।
একগুচ্ছ জুঁই আসলে একটি একক জগত, সে জগত বহুমাত্রিক। রং, রূপ, আকারে সে ভিন্ন। জুঁই সিরিজে লাল সবুজের খেলাসমূহ আমার দারুণ লাগে।
By অভী চৌধুরী
Category: কবিতা
Paperback
Ebook
Buy from other retailers
About প্রেমের কবিতা
হেলেন, বনলতা সেন কিংবা জুঁই

‘বললাম, আমি অভী, আপনার ছাত্র;
মনে বললাম টিচার, তুমি কি এখনও আমার কথা ভাবো?’
- কবিতা মন্ডল ৩

কবি অভী চৌধুরী এখানে নিজেই কবিতার বিষয় ও চরিত্র। সেই সঙ্গে টিচারকে প্রকাশ্যে আপনি আর মনে মনে তুমি বানিয়ে কবিতার শরীরে এনে দেন অন্যমাত্রা। এই অন্য মাত্রাটাই বোধহয় তার কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। যেখানে মনে হয় যুগ যুগ ধরে আমরা অনেকে মিলে একটি কবিতা লিখে যাচ্ছি সেখানে অভী অন্যতর। এমনকি যেখানে পুরনো অনুষঙ্গ আসে সেখানেও সে নতুন, অন্য রকম।
‘স্মৃতির সমস্ত অক্ষর মুছে যায়, কবিতা
তুমি শুধু থাকো দিনের আলোর গভীরে
রাতের আর একটি তারাও থাকে না।’
- কবিতা মন্ডল ২

রবীন্দ্রনাথকে মেনেও তাকে ছাপিয়ে অন্য কোনো না-মানার দেশে চলে যান প্রেমিক কবি অভী। তার কবিতা বলয়ে প্রভাব ও প্রভাবের ঊর্দ্ধে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ। ‘জুঁই, তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে!’(একগুচ্ছ জুঁই ২৬) কী অবলীলায় রবীন্দ্র উচ্চারণকে একাত্ম করে নেন তিনি! কারণ অভী চৌধুরী সকালে রবীন্দ্রনাথের জন্য ডাল রান্না করেন, দুপুরে জুঁইদি এসে খেয়ে চলে যায়, ‘বিকেলে জুঁইদি এল না- সারাদিন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিষ্ফল ঘরে বসে কাটলো!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৩০) রবীন্দ্রনাথও নিষ্ফল হয়ে যান জুঁইদি না এলে। জুঁইদির কথা আবার রবীন্দ্র বয়ানে পেয়ে যাই, ‘- সমূহ প্রেমিকা, জুঁই, তুমি কি কেবলই ছবি শুধু পটে লিখা?’ (একগুচ্ছ জুঁই ৩৭)। জুঁইদির কথা পরে হবে, আগে কবি অভী’র খামখেয়ালির কথা হোক। প্রেম ও প্রেমের কবিতায় তিনি জাগলিং করেন শব্দ নিয়ে, পাওয়া-না-পাওয়া-পরম পাওয়ার হাওয়া এসে উল্টেপাল্টে দেয়া তার কবিতার জগত। কখনো তিনি ভীষণ কলোকিয়াল, কখনো ক্যাজুয়াল, কখনো ভয়ংকর একগুয়ে। এইসব মিলিয়ে তার প্রেমের কবিতার মেজাজটাই আলাদা।
‘এই তো, আমার মুড়ি দিয়ে খামাখা চা ভিজিয়ে খাওয়া,
এবং তোমার উড়ে যাওয়া, আর পতঙ্গের সান্নিধ্য পাওয়া
প্রেম এই তো, আর কিছু না’
- প্রেম ও পতঙ্গ
খাওয়া-যাওয়া-পাওয়া‘র ছকে কবি প্রেমের শ্বাশত চক্রটি বেঁধে দেন আমাদের ঠুলি বাঁধা চোখের সামনে। সেই চক্র পাকে ঘোরা সদা সৌখিন নয়। তাই কবির কাছে কখনো মনে হয় ‘প্রেম, খামাখা এসেছ’।
‘প্রেম, দেহাতীত নও
প্রেম, দূরে গিয়ে মরো
আমি এক বাঁকা নায়ের মাঝি
প্লিজ, কাছে এসো না।’
আবার ‘প্রেম, তুমি নাই’ কবিতায় তিনি বলছেন -
‘ভালোবাসা, তুমি আমাকে করলে না কোনোদিন
প্রেম, তুমিও এসে করে গেলে না আমাকে
ভালোবাসা, কী করে হবে? বলো, প্রেম এভাবে কী করে হবে!’
মুড়ি খাওয়া, করাকরি, হওয়া-না-হওয়াটা বাঁকা নায়ের মাঝি অভীর কবিতায় অন্য মাত্রা এনে দেয়। ‘প্রেম ও পতঙ্গ’, ‘প্রেম, খামাখা এসেছ’ কিংবা ‘প্রেম, তুমি নাই’ কবিতাত্রয়ীতে প্রেম-অপ্রেমের দ্বিধা থর থর চুড়া লক্ষ্য করি।
অভী চৌধুরীর কবিতা মন্ডল, একগুচ্ছ জুঁই কিংবা সম্পর্ক সিরিজের কবিতাগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য এগুলো এক রৈখিক নয়। যেমন সম্পর্কের কবিতাগুলো ত্রিভুজ প্রেমের টানে টানটান। বাংলাভাষায় এমন সরল অথচ সাহসী ভঙ্গিতে ত্রিভুজ প্রেমের কবিতা বোধহয় কমই আছে, মানে আমার পোড়া চোখে পড়েনি খুব একটা।
‘একটি ছেলে দুইটি মেয়েকে ভালোবাসে-
দুইটি মেয়ে একটি ছেলেকে ভালোবাসে-
অথচ মেয়ে দুটি পরস্পরকে ভালোবাসতে পারলো না এখনও’ - সম্পর্ক
ভালোবাসার ত্রিভুজ আরও গভীরতর হয় ‘সম্পর্ক ৩’ কবিতায়।
‘সে তোমাকে, তুমি আমাকে আর
আমি ওকে ভালোবেসে
আমাদের ছয়টি বাহু
এক অলৌকিক ষড়ভুজে জড়িয়ে গেছে!’
আষ্টেপৃষ্ঠে একাকার হয়ে ওঠে প্রেমিক, প্রেমিকা আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী
কবি অভীর আরাধ্য জুঁই বা জুঁইদির ক্ষেত্রে এই ত্রিভুজ যেন বিষম কৌণিক বাহু হয়ে আঘাত হানে বারেবার। এলান পো’র যেমন হেলেন, জীবনানন্দের যেমন বনলতা সেন, অভী চৌধুরীর কলমে আছে তেমন জুঁইদি। কিন্তু জুঁই কখনো তুই, কখনো জুঁইদি তুমি। কে এই জুঁই, কেন জুঁই, কেন সে বারবার আসে? এইসব প্রশ্নের উত্তর কবির কাছে নয়, কবির কবিতাতেই রয়ে যায়।
নিঃসন্দেহে জুঁই বিবাহিতা। তার স্বামীটি বেকুব, ছোটলোক, কারণ সে জুঁইকে বিয়ে করেছে, সে জুঁইয়ের সঙ্গে ঘুমায়। ঈর্ষায় দগ্ধ ত্রিভুজ কবিতা বলে ওঠে তাই
‘পুনঃপুনশ্চ : তোমার স্বামী প্রকৃতপক্ষে কোনো ছোটলোক হয়তো নয়; এটাই তার দোষ যে, তোমার সঙ্গে সে ঘুমায়।’ (একগুচ্ছ জুঁই ৪৯)
‘পেছনের বাসেই তোমার বেকুব বর ছিল; - ও তোমাকে বিয়ে করেছে কেন!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৬২.ক)
‘কে সত্য জুঁই, তোর স্বামী? - নাকি আমি?’(একগুচ্ছ জুঁই ৭২.খ)
এই ত্রিভুজের সবটাই অভী নিজে গড়তে চান একাই দুই হয়ে। জুঁইকে স্বামী ও প্রেমিক অথবা সবকিছু হিসাবে গ্রহণ করতে চায় কবি। কোথাও কারো সঙ্গে জুঁইকে ভাগাভাগি করবেন না বলেই বলেন -
‘জুঁই, ইচ্ছে হয় তোমাকে দু-পাশ থেকে জড়িয়ে রাখি
ইচ্ছে হয় তোমার দু-পাশে দু-জন হয়ে শুয়ে থাকি!’
জুঁইকে পুরোটা পেতে গিয়ে নিজেকে নিবেদন করেন পুরুষ কবি অভী চৌধুরী -
‘জুঁই, তুমি আমার স্বামী হবে? আমি তোমার গৃহবধু হতে চাই!’
বাংলা পুরুষতান্ত্রিক কবিতার মানচিত্রে প্রেমিকা বা আরাধ্যে গৃহবধু হয়ে ওঠার নজির একেবারেই ভিন্ন এবং যথার্থই অন্য মায়া ও বিভ্রম তৈরি করে। সুরিয়ালিজম কিংবা এক্সপ্রেশনিজমের চেয়েও গভীর কিন্তু অভিব্যক্তি বা পরাবাস্তবতার ক‚হক তৈরি হয় প্রেমের কবিতায়। আরেকটু নিহিতার্থের খোঁজে, পড়া যাক ‘একগুচ্ছে জুঁই’য়ের আরো কিছু পঙ্ক্তিমালা
‘জুঁইদি, ইচ্ছে হয় তোমাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি অন্ধকারে, মাঝরাতে, একা!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৩)
‘বৃষ্টি এলে মনে হয়, জুঁইদি নেমে এসেছে, লজ্জায় ভিজতে পারি না, ভয়ে ভিজতে পারি না।’ (একগুচ্ছ জুঁই ৪২)
‘জুঁইদি, তুমি পলায়নপর, এমনই জটিল,
পুরো কলিকাতা হারবাল
গিলে খেলেও তোমাকে পাওয়া মুশকিল
তোমাকে পারা মুশকিল!’(একগুচ্ছ জুঁই ১৬)
‘জুঁই, আমি মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাই
তুমি যদি মিশিয়ে দিতে পারো, এসো
তোমার পা চেটে দিই, পা চেটে দিই!’(একগুচ্ছ জুঁই ২১)
‘ইচ্ছে হয় ‘টায়ার’ হয়ে যাই
গাড়ির গতির সাথে চলে যাই
জুঁই, তোমার পাশে!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৩৫)
পা চেটে দেয়া, পেরে ওঠা, অন্ধকারে শ্রদ্ধা করা, লজ্জায় বৃষ্টিতে ভিজতে না-পারা, টায়ার হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা এ সবই অন্য কোনো ঘোরের জগত। আমাদের ক্লিশে ‘ওগো, হ্যাঁগো, আমি, তুমি’র কবিতার জগতে একগুচ্ছ জুঁই একটা বড় ব্ল্যাকহোল অনাবিষ্কৃত, অচেনা কিন্তু প্রবল তার টান।
একগুচ্ছ জুঁই আসলে একটি একক জগত, সে জগত বহুমাত্রিক। রং, রূপ, আকারে সে ভিন্ন। জুঁই সিরিজে লাল সবুজের খেলাসমূহ আমার দারুণ লাগে।
‘জুঁই, তুমি আমার বিষাদসমূহ
কামরাঙা ফলের মতো বাসনাবিদ্ধ, সবুজ নিরীহ!’ (একগুচ্ছ জুঁই ২৭)
‘ তোমার জামার মতো নরম সবুজ ঘাস
আহা! যদি খাওয়া যেত
সবুজের সমূহ আড়াল!’
‘জুঁই, তুমি দূরে চলে গেলে
তোমার লাল জামা রক্তবিন্দু বলে মনে হয়!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৫)
‘তোমার সবুজ জামা, সে তো লাল নয়, তবু তা
রক্তবিন্দু বলে মনে হবে!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৭৮)
কবিতায়, বিশেষত বাংলা কবিতা উইটের স্তরটা খুব তলানিতে পড়ে আছে। সেই দিক থেকেও একগুচ্ছ জুঁইয়ে অনেক রসিকতা, কৌতুকের ছড়াছড়ি আছে, গাঢ় ও হাল্কা উভয় চালেই
‘তোমাকে বললাম: সহস্র চুম্বন; আর উত্তরে তুমি বললে, ‘আল্লাহ হাফেজ’। জুঁই তোমার ভাষাজ্ঞান বড়োই কম!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৫৮.খ)
‘মনে মনে তোমার বাড়ি চুমু খেতে যাই - জুঁই; চা খেয়ে চলে আসি!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৮৯)
‘জুঁই, তুই টাইটানিক, পরম-জাহাজ; আমি চালাবো
আজ ডুবে গেলে ডুবে যাব!’ (একগুচ্ছ জুঁই ৯৬)
‘জুঁই, তোমাকে আমি অনেক ভালো আছি
তুমি আমাকে ভালো আছ তো?’(একগুচ্ছ জুঁই ৬৫.ছ)
ভাষা ব্যবহারেও অন্য রকম একগুচ্ছ জুঁই। উদ্ধৃতাংশগুলো লক্ষ্য করলে কবির নিজস্ব ভাষাভঙ্গিগুলি বোঝা যায়। একটি ছত্র বিশেষ করে তুলে দিচ্ছি
‘কাল বিকেলে অনেক মহিমা ছিল জুঁই তোমার চুম্বনে
তবু মন দমে আছে তোমার সমূহ গ্লানি আর গাঢ় ডিপ্রেশনে।’ (একগুচ্ছ জুঁই ৪৭)
সমূহ গ্লানি আর গাঢ় ডিপ্রেশনের পরেও সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত জুঁই রয়ে যায়। হেলেন, বনলতা সেনের চেয়ে জুঁইয়ের শক্তিটা এখানেই বেশি, যে জুঁইকে পেতে গিয়ে কবি নিরাকার হয়ে যেতে পারে, হাহাকার করতে পারে।
‘ধরো, যদি নিরাকার হয়ে যাই,
যখন-তখন ঢুকে পড়ি তোমার আয়নায়,
কেবল তুমিই আমাকে ছুঁতে পারো, আর কেউ না;
দারুণ হতো, তাই না।’ (একগুচ্ছ জুঁই ১১০)
এই দারুণ হয়ে ওঠার কারুকাজ সব জুঁইকে ঘিরেই ঘটে। আব্দার, আহ্লাদ, অভিমান, ঈর্ষার সব কিছুর ফ্যাক্টরি নিয়ে একগুচ্ছ জুঁই, যেখানে গুচ্ছ সমূহ ছাড়িয়ে জুঁইকে পুরোটা একক করে হরণ করে নিতে চায় কবি অভী চৌধুরী।
‘জুঁই, একটা আলিঙ্গন দিয়ো, আর সহস্র চুম্বন
সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে। তোমার
দুধ-মাখা ভাত শুধু আমাকেই দিয়ো।’ (একগুচ্ছ জুঁই ৬৪)
শুধু জুঁইয়ের দুধ-মাখা ভাত খেলে কবির মন ভরে না, পেটও ভরে না। কারণ জুঁই না হলে সবই মিথ্যে হয়ে যায়, এমনকি সূর্যও।
‘যে সূর্য আমার জুঁইদিকে দেখায় না
সে কখনো আলোর উৎস হতে পারে না!’ (একগুচ্ছ জুঁই ২৯)
এমন তীব্র অনুভব, বোধ, আবেগ, উল্লাস আর বেদনার অমনিবাসে আপনাদের স্বাগতম জানাই প্রিয়তম পাঠক, আসুন, আবিষ্কার করুন প্রেম, অভী চৌধুরীর প্রেমের কবিতায়।

মুম রহমান
Creative Dhaka
  • Copyright © 2025
  • Privacy Policy Terms of Use